কিশোর-কিশোরীদের প্রতি সহিংসতা
জেন্ডার বৈষম্য ও যৌন নির্যাতন/জেন্ডার ভিত্তিক নির্যাতন
১. কৈশোরকালে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে কি ধরনের জেন্ডার বৈষম্য হয়ে থাকে?
উত্তর: জীবনের প্রায় ক্ষেত্রেই একজন নারী বা একটি মেয়ে মানুষ হিসেবে তাদের যে প্রাপ্য, সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আর এই বৈষম্যসমূহ মারাত্মকভাবে একটি মেয়ের বেড়ে ওঠা এবং তার স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। আমাদের সমাজে সাধারণত মেয়ে আর ছেলের মধ্যে যে বৈষম্য করা হয় সেগুলো হলো-
-
- প্রায়ই দেখা যায়, তারা ছেলেকে বেশি খাবার দেয়, কিন্তু মেয়ের পর্যাপ্ত খাবারের ব্যাপারে উদাসীন থাকে
- বিয়ে দেওয়ার জন্য বা মেয়েদের নিরাপত্তার অভাবে অনেক সময় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে জীবন গঠনে বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে একটি মেয়ে ছেলেদের চাইতে বরাবরই পিছিয়ে পড়ে।
- স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রেও মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। গর্ভাবস্থায়ও কিশোরী মাকে অনেক সময় সঠিক যত্ন নেয়া হয় না। ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায় ।
- সাধারণত ছোটবেলা থেকেই একটি মেয়েকে পরিবারে খাটো করে দেখা হয়, কাজের স্বীকৃতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাকে অবহেলা করা হয়। বিয়ে, লেখাপড়া, খেলাধূলা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মেশা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে মেয়ের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেক পরিবারের সদস্যরা দেয় না
- একটি ছেলে ও একটি মেয়ে একই কাজ করছে কিন্তু তাদেরকে পারিশ্রমিক একই রকম দেয়া হয় না । মেয়েরা যখন গর্ভবতী হচ্ছে তখন অনেক ক্ষেত্রে তাকে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে না।
- বেশির ভাগ সময়ই একটি মেয়ে কখন বিয়ে করবে, কখন এবং কয়টি সন্তান নিবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
২. যৌন নির্যাতন বলতে কি বুঝায়? কিশোর-কিশোরীরা কি ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়?
উত্তর: নিপীড়ন বা নির্যাতন যা দ্বারা সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির সম্ভ্রম, সম্মান ও সুনামের ক্ষতি হয়। যৌন আকাক্সক্ষা ও চাহিদা পূরণে বিশেষ ধরণের নির্যাতন যা নারীর শরীর ও মনের উপর সংঘটিত একটি জঘন্যতম অপরাধ। যেমন -
- ধর্ষণ
- জোরপূর্বক যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা
- দলবদ্ধ ধর্ষণ
- প্রতারণামূলক বিয়ে বা যৌন সম্পর্ক স্থাপন
- ধর্ষণের চেষ্টা
৩. যৌন নিপীড়ন করলে বা যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করতে চাইলে একজন কিশোর বা কিশোরী কি করতে পারে?
উত্তর: যৌন নিপীড়ন করলে বা যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করতে চাইলে একজন কিশোর বা কিশোরীকে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে, যেমন: “না” বলা; যৌন নিপীড়নকারী পরিচিত বা অপরিচিত যে-ই হোক না কেন, যদি কেউ একজন কিশোর-কিশোরীকে এমনভাবে স্পর্শ করে যা তার কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়, তবে সে অবশ্যই মানা করবে, একা নির্জন স্থানে অবশ্যই যাবেনা, কোলাহলপূর্ণ জায়গার দিকে চলে যাবে যেখানে অন্য লোকজন রয়েছে। কেউ ক্ষতি করতে চাইলে বা আঘাত করতে চাইলে জোরে চিৎকার করে কাউকে ডাকবে। নিজের প্রতি ঘটে যাওয়া নির্যাতন/সহিংসতা কখনও লুকিয়ে রাখা যাবেনা। কখনো কখনো কেউ কিশোরকিশোরীদের প্রতি খারাপ বা ভুল কিছু করলে তারা সবসময়ই কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে। এধরনের ঘটনা ঘটলে অবশ্যই সেটা মা-বাবা বা ঘনিষ্টজনদের জানাতে হবে। এক্ষেত্রে লজ্জা বা সংকোচ বোধ করা যাবে না।একজন কিশোর-কিশোরীকে ‘নিরাপদ স্পর্শ’ ও 'অনিরাপদ স্পর্শ’ - এর পার্থক্য বুঝিয়ে বলতে হবে। দুই হাত প্রসারিত করে এবং পা থেকে দুই হাতের মাঝের আঙুলের সাথে কাল্পনিক রেখা টানলে যে সীমানা তৈরি হয় তাই হলো একজন কিশোর-কিশোরীর শরীরের সীমানা এবং এই সীমানা একান্তই তার ব্যক্তিগত। অনাকাক্সিক্ষত কারো এই সীমানা এবং স্থান অতিক্রম করার অধিকার নেই, একথা তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। এই সীমানার মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত কাউকে ঢুকতে না দিলে নির্যাতনের আশঙ্কা কম থাকে।যৌন হয়রানির শিকার হলে জাতীয় নির্যাতন প্রতিরোধ ন্যাশনাল হেল্প লাইন নাম্বার ১০৯ এবং ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯ এ ফোন করে তাৎক্ষণিক সহায়তা পাওয়া যাবে।
বাল্যবিবাহ
১. বাল্যবিবাহ বলতে কি বুঝায়?
উত্তর: বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিয়ের জন্য মেয়েদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বৎসর এবং ছেলেদের বয়স কমপক্ষে ২১ বৎসর হতে হয়। এর আগে বিয়ে হলে তাকে বাল্যবিবাহ বলে। আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বাল্যবিবাহ দন্ডনীয় অপরাধ।
২. বাল্যবিবাহের পরিণাম গুলো কি কি?
উত্তর: বাল্যবিবাহের কারণে যে সকল সমস্যা বা পরিনাম গুলো হয়ে থাকে, সেগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা যায় তাহলো-
স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক

৩. বিশ বয়সের বছরের আগে সন্তান ধারন কেন ঝুঁকিপূর্ন?
উত্তর: একটি মেয়ের ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান নেয়া মা ও শিশুর স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর। কারণ এ সময় কিশোরীর নিজেরই শারীরিক বৃদ্ধি অসম্পূর্ণ থাকে, তাই তার পুষ্টিসহ শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ তখনও চলতে থাকে। যদি এই বয়সের আগে কোন মেয়ে গর্ভবতী হয়, তবে তার নানান ধরনের শারীরিক সমস্যা হয়। কারণ এ সময়ে মেয়েদের কোমরের হাড় সঠিকভাবে পরিণত হয় না, তাই গর্ভবতী হলে পেটের বাচ্চা বেড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট জায়গা পায় না। ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়-আর এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কম থাকে। এছাড়া অল্প বয়সে সন্তান প্রসবের রাস্তাটি ছোট থাকে তাই বাচ্চা হওয়ার সময় অতিরিক্ত চাপের ফলে এ রাস্তা ছিঁড়ে যায় এবং প্রসবজনিত ফিস্টুলা হয়, অনেক সময় বাচ্চা বের হতেও অনেক কষ্ট হয়। এ বয়সে গর্ভবতী হলে মা ও সন্তান কি ধরণের ঝুঁকিতে থাকে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
-
- গর্ভজনিত উচ্চ রক্তচাপ
- গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতা
- প্রি-একলাম্পশিয়া
- বাধাগ্রস্থ প্রসব
- মৃত সন্তান প্রসব
- সময়ের আগে সন্তান জন্মদান
- কম ওজনের সন্তান জন্ম দেয়া
- প্রসব পরবর্তী বিষন্নতাা
- অপর্যাপ্ত শিশু পরিচর্যা
- অপর্যাপ্ত বুকের দুধ
৪. কিশোর-কিশোরীরা কিভাবে নিজের বা বন্ধুদের বাল্য বিবাহ থেকে রক্ষা করতে পারে?
উত্তর: কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের, বন্ধুদের এবং পরিবারের সদস্যেদের সচেতন করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারে। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে তাদেরকে যেমন ভালভাবে জানতে হবে অনুরূপভাবে বন্ধু ও পরিবারের সদস্যেদের ভালভাবে জানাতে হবে। এইক্ষেত্রে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। নিজেদেরকে ভবিষতে কিভাবে দেখতে চায় তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে এবং এই বিষয়ে পরিবারের সদস্যেদের জানাতে হবে এবং তাদেরকে অনুপ্রানিত করতে হবে। এছাড়া বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত কলসেন্টারে ফোন (কলসেন্টার নং ১০৯) করেও সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।