মডিউল - ৪
জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও কিশোর-কিশোরীদের প্রতি সহিংসতা
জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা
জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা হলো মেয়েশিশুসহ বিভিন্ন বয়সের নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বিরুদ্ধে সংঘটিত আচার আচরণ যা ব্যক্তির স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন, আইনগত বিধান দ্বারা আরোপিত ব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে শুধুমাত্র নারী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করার কারণে যেভাবে অর্থনেতিক, সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, আক্রমণ, হুমকি ও আঘাতের শিকার হয় তাই জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা।
জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও নির্যাতনের ধরন:
১. শারীরিক নির্যাতন
এমন কোনো কাজ বা আচরণ করা, যার দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির (নারী ও শিশুর) জীবন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা শরীরের কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে অপরাধমূলক কাজ করতে বাধ্য করা বা প্ররোচনা প্রদান করা বা বলপ্রয়োগ যেমন :
- মারধর, আঘাত ও যেকোনো শারীরিক নির্যাতন
- অ্যাসিড আক্রমণ
- পাচার
- অপহরণ
- হত্যা
- আত্মহত্যায় প্ররোচনা বা বাধ্য করা
- ধাক্কা দেয়া
- গলা চিপে ধরা
- চুলের মুঠি ধরে টানা
- চড়, থাপ্পড় ইত্যাদি
২. মানসিক নির্যাতন
নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহ অর্ন্তভুক্ত হবে -
ক. মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভীতি প্রদর্শন বা এমন কোনো উক্তি করা, যা দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির মানসিকভাবে ক্ষতি হয়
খ. হয়রানি
গ. ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ অর্থাৎ স্বাভাবিক চলাচল, যোগাযোগ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশের উপর হস্তক্ষেপ; যেমন :
- কোথাও যেতে বাধা দেয়া
- গালমন্দ করা
- অপমান করা
- হেয় করে কথা বল
- বিরক্ত করা
- সন্দেহ করা
- বিভিন্ন ধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা
- মানসিক অশান্তি বা অস্থিরতা করা ইত্যাদি
৩. যৌন নির্যাতন
নিপীড়ন যা দ্বারা সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির সম্ভ্রম, সম্মান ও সুনামের ক্ষতি হয়। যৌন আকাক্সক্ষা ও চাহিদা পূরণে বিশেষ ধরনের নির্যাতন যা নারীর শরীর ও মনের উপর সংঘটিত একটি জঘন্যতম অপরাধ। যেমন -
- ধর্ষণ
- ধর্ষণের চেষ্টা
- দলবদ্ধ ধর্ষণ
- প্রতারণামূলক বিয়ে বা যৌন সম্পর্ক স্থাপন
- জোরপূর্বক যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা ইত্যাদি
৪. “আর্থিক ক্ষতি” অর্থে নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহও অন্তর্ভুক্ত হবে, যথা-
(অ) আইন বা প্রথা অনুসারে বা কোনো আদালত বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যে সব আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, সম্পদ বা সম্পত্তি লাভের অধিকারী তা থেকে তাকে বঞ্চিত করা অথবা উপর তার বৈধ অধিকার আদায়ে বাধা প্রদান;
(আ) সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র প্রদান না করা;
(ই) বিবাহের সময় প্রাপ্ত উপহার বা স্ত্রীধন বা অন্য কোনো দান বা উপহার হিসেবে প্রাপ্ত কোনো সম্পদ থেকে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা বা তার বৈধ অধিকার আদায়ে বাধা প্রদান;
(ঈ) সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির মালিকানাধীন যেকোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি তার অনুমতি ব্যতিরেকে হস্তান্তর করা বা এর উপর তার বৈধ অধিকার আদায়ে বাধা প্রদান
(উ) পারিবারিক সম্পর্কের কারণে যেকোনো সম্পদ বা সুযোগ-সুবিধা দিতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির ব্যবহার বা ভোগ দখলের অধিকার রয়েছে তা থেকে তাকে বঞ্চিত করা বা এর উপর তার বৈধ অধিকার প্রয়োগে বাধা প্রদান যেমন -
- যৌতুক দাবি করা
- গয়না, সম্পত্তি নিয়ে নেয়া
- বেতন নিয়ে নেয়া ইত্যাদি
- স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে ভরণপোষণ না দেয়া
- অর্থনৈতিক বা উপার্জনমূলক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়া বা বাধা দেয়া
৫. যৌন হয়রানি
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ যৌন নির্যাতন বিষয়ে বিগত ১৪ মে, ২০০৯ তারিখে রিট পিটিশন নং ৫৯১৬/২০০৮- এর প্রেক্ষিতে এক যুগান্তকারী নির্দেশনা প্রদান করেছে। যার মাধ্যমে যৌন নির্যাতন ও হয়রানির সংজ্ঞার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যৌন হয়রানি বলতে বোঝায়-
ক) অনাকাক্সিক্ষত যৌন আবেদনমূলক আচরণ (সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে) যেমন : শারীরিক স্পর্শ বা এমন প্রচেষ্টা;
খ) প্রশাসনিক, কর্তৃপক্ষীয় ও পেশাগত ক্ষমতা অপব্যবহার করে কারো সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা;
গ) যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি;
ঘ) যৌন সুযোগ লাভের জন্য অনাকাক্সিক্ষত দাবি বা আবেদন;
ঙ) অনাকাক্সিক্ষত পর্নোগ্রাফি দেখানো;
চ) যৌন আবেদনমূলক অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য বা ভঙ্গি;
ছ) অশালীন ভঙ্গি, যৌন নির্যাতনমূলক ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্যক্ত করা, কাউকে অনুসরণ করা, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা;
জ) চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস, ফ্যাক্টরি, শ্রেণিকক্ষ, বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কিছু লেখা;
ঝ) ব্ল্যাকমেইলিং অথবা চরিত্র লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে স্থির চিত্র এবং ভিডিও চিত্র ধারণ করা;
ঞ) যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির উদ্দেশ্যে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা;
ট) প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেয়া বা চাপ প্রয়োগ করা;
ঠ) ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণা/ছলনার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে চেষ্টা করা।
কৈশোরকালীন সহিংসতার কারণ
- ব্যক্তিগত কারণ: একজন ব্যক্তি নির্যাতনের শিকার হবে, না নির্যাতনককারী হবে তার পেছনে অনেক ক্ষেত্রে বংশগত বা শারীরিক উপাদান কাজ করে। যেমন: বংশগত, শারীরিক অক্ষমতা, নৈতিকতার অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বৈকল্য, মানসিক অস্থিরতা এবং ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য (বয়স, শিক্ষা, আয়) ইত্যাদি।
- পারস্পরিক কারণ: পারিবারিক বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, বৈবাহিক সম্পর্কের অবনতি, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব ইত্যাদি কারণেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
- পারিপার্শ্বিক কারণ: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিসে এবং রাস্তাঘাটে সমবয়সীদের চাপ,রাজনৈতিক প্রভাব, সুস্থ বিনোদনের অভাব এবং মুক্ত আকাশ অপসংস্কৃতির কারণেও নির্যাতন সংঘটিত হয়। এছাড়াও সামজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাবের কারণেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে।
- সামাজিক কারণ: বাংলাদেশে যুবসমাজের অধিকাংশই নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণে এবং বেকার ও হতাশাব্যঞ্জক জীবনযাপন করে থাকে। আবার সামাজিকভাবে অপ্রতিষ্ঠিত, পরনির্ভরশীল, হীনমন্য ও হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তিরা এই ধরণের অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করে থাকে। সুস্থ সামাজিকীকরণের অভাবেও এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে, যেমন: শৈশবকাল থেকে যখন বয়ঃজেষ্ঠ্যদের কোনো মেয়ের সাথে অন্যায় আচরণ করতে দেখে তখন সে এই বিষয়ে উৎসাহী হয়।
সহিংসতার প্রভাব
সহিংসতার প্রভাব বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে নির্যাতনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়:
- শারীরিক প্রভাব: মাথা ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, বমি-বমিভাব অনিদ্রা ইত্যাদি
- মানসিক প্রভাব: দুশ্চিন্তা, মনমরা, বিষণœতা, বিরক্তিবোধ, রাগান্বিত, খিটখিটে মেজাজ, ভয় পাওয়া এবং অসহায়বোধ করা, নিরাপত্তার অভাব, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তাবোধ, অপমানিত বোধ, অপরাধবোধ, পুরুষের প্রতি ঘৃণা জন্মানো ও আত্মহত্যা ইত্যাদি
- আচরণগত প্রভাব: কান্নাকাটি করা, মনোযোগ দিতে না পারা, ভিড়ের জায়গা ও পাবলিক পরিবহন হতে নিজেকে বিরত রাখা ইত্যাদি
- সামাজিক প্রভাব: সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া, বাবা-মা ও গুরুজনদের তিরস্কার, সামাজিক কর্মকান্ড হতে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া ইত্যাদি।
সহিংসতা প্রতিকার ও প্রতিরোধের পন্থাসমূহ
- পারিবারিক ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যকার বন্ধন জোরদার করা।
- সন্তান ও বাবা-মা/অভিভাবকের মধ্যে নিরাপদ, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি।
- শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জীবনমুখী প্রশিক্ষণ, যেমন: কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা যাবে, রাগ নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক দক্ষতা বিকাশ প্রশিক্ষণ, কীভাবে বাবা-মা ও বন্ধুদের সাথে দ্বন্দ্ব কাটানো যাবে, কম্পিউটার ও কারিগরি প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।
- মাদকের অপব্যবহার ও সহজলভ্যতা হ্রাস।
- জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে বিবিধ সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা।
- নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা দমন আইন সম্পর্কে জনগণ ও জনপ্রশাসনকে সোচ্চার করা।
- সমাজে বেকারত্ব হ্রাস, দারিদ্র বিমোচন করার লক্ষ্যে ক্ষুদ্রশিল্প প্রশিক্ষণ এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদান।